ব্লগ
বছর পর্যালোচনা : কেমন ছিলো ২০২২ সালের দাবা?

বছর পর্যালোচনা : কেমন ছিলো ২০২২ সালের দাবা?

whatagoodday
|

২০২২ সাল ছিলো দাবার জন্য অন্যতম সেরা একটা বছর। দাবাবিশ্বে ঘটেছে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা, পেয়েছি অনেক নতুন ‘ভবিষ্যৎ’ সুপারস্টার। অবাক করে দেয়ার মতো ঘটনাও যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি প্রত্যক্ষ করেছি হতাশা উদ্রেককারী অনেক দৃশ্য। অনেককে হারিয়েছি, পরিবর্তে পেয়েছি আরো অনেককে। প্লাস এবং মাইনাসের ঝুলি সব একত্র করলে শেষমেষ আমাদের কাছে আর কি থাকে? চলুন দেখে আসি! 


বছরটা শুরু হয়েছিলো নেদারল্যান্ডের ভাইক আন জি’তে অনুষ্ঠিত টাটা স্টিল মাস্টার্স টুর্নামেন্ট দিয়ে। ১৫ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া রাউন্ড রবিন এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন, রানার-আপ হয়েছিলেন আজারবাইজানের শাখরিয়ার মামেদিয়ারভ, তৃতীয় স্থান লাভ করেছিলেন রিহার্ড র‍্যাপোর্ট। 

© Chess.com

টাটা স্টিল মাস্টার্সের পাশাপাশি টাটা স্টিল চ্যালেঞ্জার্স নামক আরেকটা টুর্নামেন্ট চলছিলো একই সময়ে যেখানে চ্যাম্পিয়ন হন ভারতীয় অর্জুন এরিগেইসি, রানার-আপ হন চেক রিপাবলিকের থাই ডাই ভন নুয়েন এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেন ডেনমার্কের জোনাস বিউল বিয়েরে। 


২০২২’র মে মাসে বুখারেস্টে অনুষ্ঠিত হয় সুপারবেট চেস ক্লাসিক। রাউন্ড রবিন পদ্ধতির এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন ‘দি ফ্রেঞ্চ’ ম্যাক্সিম ভাশিয়ের-লেগ্রাভ, রানার-আপ এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেন যথাক্রমে ওয়েসলি সো এবং লেভন আরোনিয়ান।


একই মাসের ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় নরওয়ে চেস। চ্যাম্পিয়ন কে হন- আন্দাজ করুন তো! 
হ্যাঁ, যা ভাবছেন- ঠিক তাইই কিন্তু! ঘরের ছেলে ম্যাগনাস কার্লসেন নরওয়ে চেস’র মুকুট ছিনিয়ে নেন। দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন শাখরিয়ার মামেদিয়ারভ। তৃতীয় স্থান আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্বনাথন আনন্দের হয়! আনন্দ এই বছর খুব বেশি একটা দাবা খেলেন নাই। নরওয়ে চেস-এ ‘মাদ্রাজ টাইগার’কে আবার গর্জে উঠতে দেখা যায়।

Carlsen ground Mamedyarov down to take the lead during Norway Chess 2022. Photo: Maria Emelianova/Chess.com.

জুনের ৭ তারিখ থেকে শুরু হওয়া প্রাগ চেস ফেস্টিভালে ভারতীয় পেন্টালা হারিকৃষ্ণা নতুন রূপে ফেরেন। বিজয়মাল্য গলায় নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন, দ্বিতীয় হন ভিয়েতনামের গ্র্যান্ডমাস্টার ও সাবেক ব্লিটজ চ্যাম্পিয়ন লে কোয়াং লিয়েম। উক্ত টুর্নামেন্টে তৃতীয় স্থান লাভ করেন যৌথভাবে থাই ডাই ভন নুয়েন, স্যাম শ্যাংকল্যান্ড এবং ডেভিড নাভারা। 


 ১৬ জুন থেকে শুরু হয় দাবাড়ুদের আগ্রহের টুর্নামেন্ট ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট। ৮ জন গ্র্যান্ডমাস্টারকে নিয়ে ডাবল রাউন্ড রবিন পদ্ধতির এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন ইয়ান নেপোমনিয়াশি, দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন দিং লিরেন এবং তৃতীয় স্থান পান তিমুর রাজাবভ! দাবার ইতিহাসে ২০২২-এর ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট যেন ডেভিড ফিঞ্চারের সিনেমা! শুরুতে চাইনিজ গ্র্যান্ডমাস্টার দিং লিরেন কিন্তু তালিকায় ছিলেন না। আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া চেস ওয়ার্ল্ড কাপে রাশিয়ার সার্গেই কারিয়াকিন রানার-আপ হওয়ায় ফিদে’র কোয়ালিফিকেশন ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী কারিয়াকিনকে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার জোর-জবরদস্তি চলাকালীন যুদ্ধ সংক্রান্ত কিছু বিস্ফোরক মন্তব্যের কারণে FIDE Ethics and Disciplinary Commission কারিয়াকিনকে ফিদে আয়োজিত সকল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করা থেকে অব্যাহতি দেয় ৬ মাসের জন্য। ফলে বাদ পড়ে যান কারিয়াকিন, তার জায়গায় আসেন চাইনিজ দিং লিরেন (যিনি তালিকায় স্থান পান ‘সর্বোচ্চ রেটিং’ ক্রাইটেরিয়ার মাধ্যমে) 



দিং লিরেনের ক্যান্ডিডেটসে খেলার সুযোগ পাওয়ার পেছনেও কিন্তু একটা এক্সাইটিং গল্প আছে। ওর তো এমনিতেই রেটিং বেশি ছিলো- কিন্তু চূড়ান্তভাবে তালিকায় স্থান করে নিতে দরকার ছিলো ৩০ টি রেটেড গেমস। এপ্রিল ২০২২ এর রেটিং লিস্ট অনুযায়ী দিং লিরেনের রেটিং ছিলো ২৭৯৯। কিন্তু প্রয়োজনীয় ৩০ টি গেমের মধ্যে তিনি খেলেছিলেন মাত্র ৪ টি। আবার এদিকে কোভিড প্যান্ডেমিকের জন্য তিনি দেশের বাইরেও টুর্নামেন্ট খেলতে যেতে পারছিলেন না। ৩০ টি রেটেড গেমসের ক্রাইটেরিয়া কি তিনি পূরণ করতে পারবেন? 


এগিয়ে আসলো চাইনিজ দাবা এসোসিয়েশন। তারা খুবই শর্ট নোটিশে দিং লিরেনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রেটেড টুর্নামেন্ট আয়োজন করলো। দিং লিরেন সেগুলোতে অংশগ্রহণ করলেন এবং ৩০ টি গেমের কোটা পূরণ করে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে স্থান নিশ্চিত করলেন। 


অত্যন্ত উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট শেষ হলো। ফলাফল? চ্যাম্পিয়ন ইয়ান নেপোমনিয়াশি, রানার-আপ দিং লিরেন। ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ না। মাঝখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন ঘোষণা করলেন তিনি আর চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য লড়বেন না! ফলে, আগামী চ্যাম্পিয়নশিপে (২০২৩ সালে) লড়াইটা হবে মূলত নেপো এবং দিং লিরেনের মধ্যেই! 


২০২২ সালে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের মধ্যে একটি ছিলো বিয়েল চেস ফেস্টিভ্যাল। ১১ থেকে ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া এই টুর্নামেন্ট জেতেন লে কোয়াং লিয়েম, রানার আপ হন আন্দ্রে এসিপেঙ্কো এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিমুর রাজাবভ। 


১৬-২৫ জুলাই জার্মানির ডর্টমুন্ডে অনুষ্ঠিত হয় ডর্টমুন্ড স্পার্কাসেন চেস মিটিং। চ্যাম্পিয়ন হন জার্মানির দিমিত্রি কোলার্জ। রানার-আপ হন বিশ্বনাথন আনন্দ এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেন মাইকেল এডামস। 
বছরের শেষদিকে, ১-১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বহুল প্রতীক্ষিত সিঙ্কেফিল্ড কাপ। চ্যাম্পিয়ন, রানার-আপ এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেন যথাক্রমে আলিরেজা ফিরৌজা, ইয়ান নেপোমনিয়াশি এবং ওয়েসলি সো-ফাবিয়ানো কারুয়ানা (যৌথভাবে)। 


এই তো গেলো ২০২২-এর সুপার টুর্নামেন্টের কথা। নিচে আরো বেশ কিছু ইভেন্ট + চ্যাম্পিয়ন যারা হয়েছেন তাদের নাম উল্লেখ করা হলো: 


ওপেন ইভেন্টসমূহ:


১। জিব্রাল্টার চেস ফেস্টিভাল
চ্যাম্পিয়ন: বিলেল বেলালসিন ও বালাজস সোনকা 
নারী চ্যাম্পিয়ন: মারিয়া মুযিচুক 


২। রিকইয়াভিক ওপেন: 
চ্যাম্পিয়ন: প্রজ্ঞানন্দ রমেশবাবু 


৩। পারাসিন ওপেন (সার্বিয়া)
চ্যাম্পিয়ন: প্রজ্ঞানন্দ রমেশবাবু 


ফিদে ইভেন্টসমূহ: 


১। ফিদে গ্র্যান্ড প্রি বার্লিন 
চ্যাম্পিয়ন: হিকারু নাকামুরা 


২। ফিদে গ্র্যান্ড প্রি বেলগ্রেড
চ্যাম্পিয়ন: রিহার্ড রাপোর্ট 


অন্যান্য ইভেন্টসমূহ: 


১। ইউরোপিয়ান ইন্ডিভিজুয়াল চ্যাম্পিয়নশিপ
চ্যাম্পিয়ন: ম্যাথিয়াস ব্লুবাউম 


২। আমেরিকান কন্টিনেন্টাল চ্যাম্পিয়নশিপ
চ্যাম্পিয়ন: তিমুর গারেয়েভ 


দলগত ইভেন্টসমূহ:


১। ৪৪ তম দাবা অলিম্পিয়াড
চ্যাম্পিয়ন: উজবেকিস্তান 
চ্যাম্পিয়ন (নারী): ইউক্রেন 


২। ফিদে ওয়ার্ল্ড টীম চ্যাম্পিয়নশিপ
চ্যাম্পিয়ন: চীন 


বিশেষ ইভেন্টসমূহ:


ফিশার-র‍্যান্ডম চেস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২
চ্যাম্পিয়ন: হিকারু নাকামুরা
ইউনাইটেড স্টেটস চেস চ্যাম্পিয়নশিপ
চ্যাম্পিয়ন: ফাবিয়ানো কারুয়ানা 


বছরের শেষ চমক হিসেবে তখনও বাকি ছিলো ওয়ার্ল্ড র‍্যাপিড এন্ড ব্লিটজ চ্যাম্পিয়নশিপ- যার দুটোতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ম্যাগনাস কার্লসেন! এর ফলে এখন তিনি দাবার সবকয়টি ফরম্যাটেই (ক্লাসিকাল-র‍্যাপিড-ব্লিটজ) বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। শুধু তাই নয়, এই তিনটি ফরম্যাটে কার্লসেন এর আগেও চ্যাম্পিয়ন ছিলেন ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে। ২০২২-এ আবারও তিনটি ফরম্যাটে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি World Triple Crown চ্যাম্পিয়নই হয়ে গেলেন! 


এত এত উৎসবের ভীড়ে শোক সংবাদ হিসেবে আসলো ৭-ই মে। মারা গেলেন গ্র্যান্ডমাস্টার ইউরি আভেরবাখ। ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ১০০-তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছিলেন। কিন্তু শরীরের অবনতি হওয়ায় তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে এবং ৭-ই মে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১২ অক্টোবর মারা যান রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার কনস্টান্টিন লান্ডা। 


উপসংহার: 


২০২২ আসলে দাবার জন্য একটা কোয়ালিটি বছর ছিলো- বলা যায় একেবারে চোখ বন্ধ করে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই খেলার উন্মাদনা বেড়েছে শতগুণ। কুইন্স গ্যাম্বিটের মত সিরিজ আসার পর পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে গেলো। এসব উন্মাদনার পাশাপাশি কিছু বিতর্কিত ঘটনাও আমরা চাক্ষুষ করেছি, যেমন: ম্যাগনাস-নিয়েমান বিতর্ক, কুইন্স গ্যাম্বিটের বিরুদ্ধে মামলা- ইত্যাদি। সবই আপনারা জানেন। এ তো গেলো আন্তর্জাতিক খবরাখবর। 


বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? 


আগের মতই। নতুন কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার এখনও আসেনি। আমরা আটকে আছি ২০০৮ সালেই। তবে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। বড়সড় ইভেন্ট হচ্ছে বাংলাদেশে। ক্লাবগুলো টুর্নামেন্ট আয়োজন করে যাচ্ছে একের পর এক- চড়া রেজিস্ট্রেশন ফি’র বিনিময়ে। 


গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়া ফিদে মাস্টার হলো কিছুদিন আগে। মনন রেজা নীড় নামের ছেলেটা বাংলাদেশি গ্র্যান্ডমাস্টারদের হারিয়ে চমকে দিচ্ছে, দেশের বাইরেও ভালো পারফর্ম করছে। রাইয়ান রশিদ মুগ্ধ নামের এক উঠতি সম্ভাবনার কথাও আমরা জানতে পারলাম। 
এছাড়া, টানা দ্বিতীয় ও সর্বমোট ষষ্ঠ বারের বাংলাদেশের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হলেন গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন। একই ইভেন্টে রানার-আপ হয়েছে আন্তর্জাতিক মাস্টার মোহাম্মদ ফাহাদ রহমান। 


এই লেখার একদম শুরুতে একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম, “প্লাস এবং মাইনাসের ঝুলি সব একত্র করলে শেষমেষ আমাদের কাছে আর কি থাকে?”


আপনারাই বলুন। ইটস ইয়োর মুভ!