ব্লগ
হুমায়ূন আহমেদের গল্পে দাবা এবং অন্যান্য

হুমায়ূন আহমেদের গল্পে দাবা এবং অন্যান্য

whatagoodday
|

হুমায়ূন আহমেদ একজন বাংলাদেশি লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, কবি। এই ভদ্রলোক পরলোক গমন করেছিলেন অনেক আগে, এই জুলাই মাসেই। যারা বাংলা ভাষা জানেন এবং বাংলা ভাষার বইপত্র পড়েন- তারা কেউ হুমায়ূন পড়েননি অথবা তার নাম শোনেননি এমনটা পাওয়া যাবেনা। আধুনিক বাংলাদেশী এবং বাংলা সাহিত্যে নিকট সময়ে তার চেয়ে বেশি কেউ প্রভাব রেখেছেন অথবা রাখতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়না। যাইহোক, ভূমিকাপর্ব বাদ দিয়ে সরাসরি আসল আলাপে ঢুকে যাই। 

এই লেখাটা পুরোপুরিভাবে পড়া শেষে ক্লিকবেইট মনে হলে তাঁর জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী না। দাবাকে ভালোবাসি বলেই চারপাশের প্রিয়/অপ্রিয় মানুষগুলির মাঝে চেতনে অবচেতনে যেকোনোপ্রকারের যোগসাজশ খুঁজি। এই লেখাটা সেই উদ্দেশ্য থেকে উৎসারিত। অর্থহীন মনে হলে এর সম্পূর্ণ দায়ভার তথ্যের অপ্রতুলতা। হুমায়ুন আহমেদের ‘খেলা’ গল্পটিই সম্ভবত প্রোপার একটা গল্প যেটা দাবাকেন্দ্রীক। সুতরাং, নিজের মত করে (অথবা, বলতে পারেন ফার্স্ট ড্রাফট) যা যা চিন্তা আসে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন-অবিচ্ছিন্নভাবে সাজালাম, অর্থাৎ লিখলাম।

হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ দাবা খেলতেন কিনা এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নাই। একেবারে শূণ্যহাতে শূণ্য থেকে লিখতে শুরু করা। তাঁর কোনো বইয়ে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা নাই। যদি থাকেও, তবে সেটা যে আমার চোখ এড়িয়ে গেছে- নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারেন। তবে মোটামুটি নিশ্চিত পর্যাপ্ত কোনো তথ্য নাই।

তাঁর এক ছোটগল্প আছে, যেখানে তিনি দাবাকে নিয়ে চমৎকার এক গল্প ফেঁদেছেন। গল্পটির নাম ‘খেলা’। অনেক আগে এই গল্পটা পড়ে বেশ থ্রিল বোধ করেছিলাম। স্বভাবতই, হুমায়ূন আহমেদের শব্দবুনন, সিনট্যাক্স চিত্তাকর্ষক। রহস্য তৈরি করতে তিনি বেশ পটু, যারা একটা হলেও গল্প পড়েছেন- তারা এ-কথা বলবেনই। অনেকবছর আগে লেখা হয়ে যাওয়া একটা গল্পকে (অ)ব্যক্তিগত জীবনের সাথে খানিক মিলিয়ে ব্যবচ্ছেদ করতে যাওয়াটা বোকামি কি না- কেউ বোকামির জায়গাটুকু ধরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত বোঝা মুশকিল। সেই বোঝাপড়ায় যেতে হলে আমাদের গল্পে ঢুকতে হবে।

খেলা'র ব্যবচ্ছেদ :

হুমায়ূন আহমেদের অন্যসকল মফস্বল শহরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত গল্পসমূহের মতই এই গল্পটি শুরু হয় খায়রুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের থার্ড স্যার বাবু নলিনি রঞ্জনের একটা চমৎকার কগনিশন দিয়ে। সেই কগনিশন হুমায়ুন আহমেদ বর্ণনা করেছেন তাঁর চিরায়ত বাক্যবিন্যাস দিয়েই –

"খায়রুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের থার্ড স্যার, বাবু নলিনী রঞ্জন একদিন দুপুরবেলা দাবা খেলা শিখে ফেললেন। এই খেলাটি তিনি দু’চোখে দেখতে পারতেন না। দু’জন লোক ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা বোর্ডের দিকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে- মানে হয় কোনো? তবুও তাঁকে খেলাটা শিখতে হলো।"

নলিনি বাবুকে খেলাটা শেখালেন স্কুলের জিওগ্রাফি স্যার, তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু- জালাল সাহেব। শেখানোর প্রসেসটা এবং প্রচেষ্টা বাস্তবের স্বাভাবিক শিখন প্রক্রিয়ার মতই,

‘টিফিন টাইমে তিনি শিখলেন বড়ে কীভাবে চলে, ঘোড়া কী করে আড়াই লাফ দেয়, গজ শুড় উঁচু করে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে থাকে।’

প্রথম প্যারাতে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার, নলিনি বাবু নিজে আগ্রহ দেখিয়ে খেলাটা শেখেননি। জালাল সাহেবের ‘জোরাজুরি’ এখানে টেক্সুয়ালি দৃশ্যমান। কারণ নলিনি বাবু, ‘জালাল সাহেবের কথা ফেলতে পারলেন না।’

সুতরাং, দেখা যায়, প্রায় অলৌকিকভাবে দাবার মৌলিক চালগুলো শিখে ফেলার পর প্রথম খেলাতেই নলিনিবাবু জালাল সাহেবকে হারিয়ে দেন। জালাল সাহেব উক্ত বিষয়টি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে ও মেনে নিতে পারে না। তিনি নলিনি বাবুকে আরেক দান খেলার আহ্বান জানান।

তৃতীয় খেলাটিতেও জালাল সাহেব হারলেন। চতুর্থ খেলাটি শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে। নলিনি বাবু জিতে গেলেন পঞ্চম খেলাতেও।

নিয়ামতপুরের খায়রুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের থার্ড স্যার বাবু নলিনি রঞ্জনের ‘উইনিং স্ট্রিক’ শুরু হলো, হুমায়ুন আহমেদ লিখলেন,

‘…তাঁকে কেউ হারাতে পারে না। তাঁর সেই খ্যাতি পনেরো বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রইলো।’

হুমায়ুন আহমেদ কাল্পনিক এই গল্পটি সাজিয়েছেন অত্যন্ত বাস্তব প্রেক্ষাপটে। কারণ তিনি জানেন- বুদ্ধির কাছে যেকোনো অবাস্তব এবং উদ্ভট খেয়াল চমৎকারভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। (শুধুমাত্র) বুদ্ধির খেলা হওয়ার কারণেই মফস্বল ব্যাকগ্রাউন্ডের এই গল্পটা অন্যান্য চরিত্রগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দাবার ইতিহাসের দিকে তাকালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্যতা মিলতে পারে। যেমন, ধরা যাক উইলহেলম স্টাইনিতজের কথা। তিনি এত দরিদ্র ছিলেন যে শৈশবে একটা দাবার বোর্ডও কেনার সামর্থ ছিল না। আবার এই উপমহাদেশেরই মীর সুলতান খানের কথা ভাবা যেতে পারে। সুলতান ছিলেন স্যার ওমর হায়াত খানের একজন সাধারণ কর্মচারী। মালিকের বদৌলতে লন্ডন যান ১৯২৯ সালে, সেখানে গিয়ে তিনি তৎকালীন সকল মাস্টার দাবাড়ুদের হারিয়ে দেন। তিনিই একমাত্র ভারতীয় দাবাড়ু যিনি ৩ বার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। এ লেখাটি অবশ্য এদিক থেকে প্রাসঙ্গিক না। কারণ, বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে মনে হলেও আদতে এটি একটি ‘লিখিত’ গল্পই।

গল্পে নাটকীয়তা আনবার লোভে হুমায়ূন আহমেদ কেবল দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। দাবায় নলিনি বাবুর সিদ্ধহস্ততা প্রমাণের জন্য তিনি ফেডারেশনের সেক্রেটারিকে দিয়ে বিদেশ থেকে একজন নামকরা খেলোয়াড়কে আনালেন।

সেক্রেটারি সাহেব নলিনি বাবুকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন:

‘আপনি খুব সাবধানে খেলবেন। যাকে নিয়ে এসেছি তিনি বেলজিয়ামের লোক। খুব উঁচুদরের খেলোয়াড়।’

নলিনী বাবুর জানা, তিনি সাবধানেই খেলেন। সেক্রেরটারি সাহেব তবু নিরাপত্তা সংকটে ভুগতে থাকেন। সেই উদ্দীপনায় তিনি নলিনি বাবুকে পুনরায় বলেন, “তাড়াহুড়া করে চাল দেবার দরকার নেই, বুঝলেন? এঁর সঙ্গে গিয়াকো পিয়ানো ডিফেন্স খেলাই ভালো। সেই ডিফেন্স জানেন তো?”

নলিনী বাবু বলেন, তিনি জানেন না!

সেক্রেটারি সাহেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হলো।

সেই সাথে ভ্রূ কুঞ্চিত হলো আমারও। গিয়াকো পিয়ানো ডিফেন্স কি আবার?

দাবায় প্রতিটি চালের কিছু না কিছু সুনির্দিষ্ট নাম আছে। খেলাটা তিনভাগে বিভক্ত। ওপেনিং, মিডল এবং এন্ড গেম। ওপেনিং হিসেবে ধরা হয় প্রথম দশ থেকে বারোটি চাল। সেই দশ থেকে বারোটি চালের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম আছে পজিশন ভেদে। যেমন, সাদা গুটির রাজার দিকের ঘোড়া শুরুতেই বের করলে সেটিকে বলা হয় ‘রেটি’ ওপেনিং' রিচার্ড রেটি নামক জনৈক মাস্টারের অবদান এই নামের পেছনে।

তো, সেরকমই গিয়াকো পিয়ানো (শুদ্ধ উচ্চারণ জকো পিয়ানো, Giuoco Piano- যার অর্থ Quiet Game) দাবার ওপেনিং’-এর অন্যতম একটি ‘ভ্যারিয়েশনের’ নাম। ভ্রূ কুঞ্চিত হবার সত্যিকারের কারণ হলো- দাবায় গভীর আগ্রহ না থাকলে একজন ব্যক্তির (হুমায়ূন আহমেদের) পক্ষে উক্ত ওপেনিংয়ের নাম জানা সম্ভব না।

মন্তব্য আসতে পারে- তিনি হয়ত গল্পটা ফাঁদবার স্বার্থেই স্বপ্রণোদিত হয়ে জটিল এক ওপেনিং ভ্যারিয়েশনের নাম খুঁজে নিয়েছেন যাতে করে পাঠক আরো আকর্ষণ বোধ করে। হ্যাঁ ভাই, হতে পারে। লেখকেরা পাঠক ধরবার স্বার্থে অনেককিছুই করতে পারে।

গল্পে ফিরি। আমাদের ফেডারেশনের সেক্রেটারি সাহেব নলিনি বাবুর এহেন মূর্খতায় লজ্জিত বোধ করে কালো মুখে বললেন:

‘প্রশিক্ষণহীন প্রতিভা দেখাতে নিয়ে এসে বড় বেইজ্জতির মুখে পড়লাম দেখি।’

মোটমাট তিনটি খেলা হলো, যার মধ্যে একটি ড্র এবং দুটো জিতলেন নলিনি বাবু। ইজ্জত বাঁচল সেক্রেটারি সাহেবের।

সময় প্রায় ফুরিয়ে এলো। নলিনী বাবু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আশ্বিন মাসের এক সন্ধায় তাঁর হাঁপানির টান প্রবল হলো। দরিদ্র নলিনি বাবুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন হুমায়ূন আহমেদ। বড় অদ্ভুত সেই চিকিৎসাব্যবস্থা। তিনি অপরাজেয় নলিনি বাবুকে দিয়ে একটি ম্যাচ খেলাবেন, সেই ম্যাচে নলিনী বাবু হেরে গেলে তাঁর প্রতিপক্ষ পাবেন ১৫ হাজার টাকা এবং শেষমেষ সেই ১৫ হাজার টাকায় তাঁর চিকিৎসা হবে। শীতে নলিনী বাবুর অনেক কষ্ট হয়। সেই টাকা দিয়ে কেনা হবে কিছু শীতের কাপড়ও।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করবার মত। জীবনের শেষ ‘আয়োজিত এবং পূর্বনির্ধারিত’ পরাজয়ের ম্যাচে নলিনি বাবুর প্রতিপক্ষ হিসেবে আছেন সবার প্রথমে নলিনী বাবুকেই দাবা খেলায় টেনে আনা দীর্ঘদিনের বন্ধু জালাল সাহেব। সাহিত্যে এরকম কোনো ঘটনার আলাদা কোনো নাম আছে? জানি না। এ যেন ইদিপাস অথবা ম্যাকবেথের নিয়তির মতই।

অবশ্য জালাল সাহেব খেলছেন চ্যালেঞ্জের খেলা। অন্তত আজ নলিনী বাবুকে হারাতেই হবে, যেকোনোভাবেই হোক। দাবার বোর্ডে ঐ সময়ের পরিস্থিতিতে চোখ মেলা যাক-

‘একটা ভুল চালে তাঁর (নলিনি বাবুর) গজ খোয়া গেল। তাঁর কিছুক্ষণ পর একটা নৌকা পিনড হয়ে গেল। অস্ফুট গুঞ্জন উঠলো চারদিকে। নলিনি বাবু দেখলেন জালাল সাহেবের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। পনেরো বছরের অপরাজেয় দাবা চ্যাম্পিয়ন আজ পরাজিত হতে যাচ্ছেন। জালাল সাহেবের মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ। চাল দেবার সময় তাঁর হাত কাঁপতে লাগলো।

হোমিওপ্যাথ ডাক্তার সোবহান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘নলিনি বাবুর অবস্থা তো খারাপ।’

জালাল সাহেব ধরা গলায় বললেন, ‘সব আমাদের নলিনির ভান। দেখবেন এখুনি সব ঠিক করে ফেলবে।’

নলিনি বাবু ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘তুমি কাঁদছ নাকি জালাল?’

‘না। চোখে কি যেন পড়লো।’

জালাল সাহেব চোখের সেই অদৃশ্য জিনসটি বের করবার জন্য চোখ কচলাতে লাগলেন।

ক্ষীন একটি হাসির রেখা কি দেখা গেল নলিনি বাবুর ঠোঁটে? তিনি ঘোড়ার একটি কিস্তি দিলেন। রাজা সরে এলো এক ঘর। দ্বিতীয় কিস্তি দিলেন বড়ে দিয়ে। রাজা আরো এক ঘর সরলো। নলিনি বাবু যেন অদৃশ্য কোনো নগরী থেকে তাঁর কালো গজটি বের করে আনলেন। সোবহান সাহেব বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘কী সর্বনাশ!’ নলিনি বাবু গজটা বড়ের মুখে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কিস্তি’

শেষ খেলাতেও নলিনি বাবু হারলেন না। দীর্ঘ ১৫ বছর অপরাজেয় চ্যাম্পিয়ন থেকে অবশেষে তিনি মারা গেলেন ১২ নভেম্বর, ১৯৭৫। রোজ মঙ্গলবার।

মজার বিষয়গুলোর কথা বলি:

  • ক্যালেন্ডারে ১২  নভেম্বর ১৯৭৫ সাল দেখাচ্ছে বুধবার। ভুলটা কি ইচ্ছাকৃত?
  • সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভের রাজত্বও ছিল ১৫ বছর (১৯৮৫-২০০০)
  • হুমায়ুন আহমেদের জন্ম ১৩ নভেম্বর।

অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা:

৯১/৯২ সালে প্রকাশিত সেই লেখাটায় গ্যারি কাসপারভের উত্তাপ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। সেই সময়টা বলতে গেলে দাবার স্বর্ণযুগ ছিল।

নলিনী বাবু যদি গ্যারি কাসপারভের প্রভাবে প্রভাবিত না হন, তবে নলিনি কি হুমায়ুন আহমেদ নিজেই? নাকি ‘সেই ফিনিক্স পাখিটার মত, আজ সন্ধায় তার মৃত্যু হলে পরদিন সকাল দেখে যার পুনর্জন্ম?’

(আমার এই লেখাটা প্রথম প্রকাশিত হয় খেলা৭১ নামক একটি ক্রীড়া জার্নালে। চেসডটকমে বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য এখানে আবার তুলে দেয়া হলো।)

ছবি গ্যালারি:

Humayun Ahmed
with his wife
in a book signing occasion
Love for the nature!
The man who lived!

Photo Courtesy: Humayun Ahmed fan page.