ব্লগ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, 'গো', দাবা, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, 'গো', দাবা, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

whatagoodday
|

এই লেখাটা বেশ আগের। এখানে দাবা এবং 'গো' খেলায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং মানব-বুদ্ধিমত্তার সামগ্রীক ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমার মনে হয় লেখাটা আরো বিস্তারিত আকারে প্রকাশ করা দরকার! 

দাবার যেকোনোপ্রকারের উপস্থিতি কোনো সিরিজ বা সিনেমার দৃশ্যের অর্থ পরিবর্তন করে দিতে পারে বহুগুণে। ইগো'র খেলা হওয়ার কারণে ব্যক্তি/বস্তুর উপর দাবার ডমিনেশন তীব্র৷ যেমন ধরা যাক, একটা দৃশ্যে দুইজন ব্যক্তির মধ্যে সংলাপ চলছে৷ সেই ব্যক্তির একজন হিরো, আরেকজন ভিলেন। এখানে এক্সপেরিমেন্টটা দুজনের উপরেই চালানো যায়, তাতে আউটকাম আসবে সম্পূর্ণ আলাদা৷ কে কাকে 'চেকমেট' দিচ্ছে, এই জিনিসটার মাধ্যমেই চরিত্রের ডমিনেশন দৃশ্যে প্রকট করে তোলা সম্ভব।


দাবার বাইরেও মাঝেমধ্যে আরেকটা খেলার উপস্থিতি দেখা যায় পর্দায়। খেলাটার নাম হচ্ছে 'গো'। দাবার থেকে বহুগুণে জটিল এই খেলাটা চীনদেশে বেশি প্রচলিত, এবং এটা যেকোনো বোর্ডগেমের থেকেও সবচে পুরোনো। চীন ছাড়াও এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে গো'র প্রচলন আছে। ইউরোপেও খেলা হয়। আয়োজন করা হয় গো চ্যাম্পিয়নশীপের, যার প্রাইজমানিও অনেক বেশি।


গো অনেকটা দাবার মতোই বলতে গেলে। বোর্ড আছে, ঘুঁটিও আছে৷ তবে দাবার বোর্ড যেমন ৮x৮ = ৬৪ ঘর, 'গো'র বোর্ড ১৯x১৯, ১৭x১৭। বিগিনার লেভেলে যারা, তারা ৯x৯ এবং ১৩x১৩ তে খেলেন সচরাচর। ঘুঁটি সাদা এবং কালো, ছোট গোল পাথরের মতো, অগনিত।


প্রাচীন চীনদেশে, একটা অভিজাত সংস্কৃতিমনা পরিবারের চারটা জরুরি শিল্পের অন্যতম হিসেবে 'গো' কে মনে করা হয়।


এই খেলার নিয়মকানুন আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও কার্যত তা এক্সট্রিমলি কমপ্লেক্স, তথা বিস্ময়করভাবে জটিল। দাবার সাথে যদি তুলনা করা হয়- তাহলে হয়তো ব্যাপারটা আরো সহজবোধ্য হবে৷
দাবায় ৬৪ ঘর নিয়ে চিন্তা করতে হয়, ক্ষেত্রবিশেষে শুধু কয়েকটা স্কয়ার নিয়ে ভাবলেই হয়। কিন্তু 'গো' গেমের ক্ষেত্রে উহা অসম্ভব। ১৯x১৯ ঘর হবার কারণে বেশুমার জায়গাজুড়ে খেলার সুযোগ থাকে। হিসেব করে দেখা গেছে, একটা গো বোর্ডে মোটমাট ২.১x১০ (টু দি পাওয়ার ১৭০) টা পজিশন সম্ভব, যা আমাদের জানা-মহাবিশ্বের যতগুলো অনু আছে তার থেকেও হাজার হাজার গুণ বেশি! অপরদিকে দাবায় সেটা ১০ টু দি পাওয়ার ১২০। দাবার সম্ভাব্য প্রথম চাল (সাদা এবং কালো মিলিয়ে) মোটমাট ৪০০, 'গো' গেমের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৯৬০!


তবে দুইটা খেলার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য আলাদা৷ দাবায় যেমন চেকমেট, গো গেমে কে কতখানি জায়গা দখল রাখতে পারে- এটার উপরই জয়-পরাজয় নির্ধারিত৷


*


গো গেম নিয়ে উৎসাহ বোধ করছি। যদিও কোনোদিন খেলবো বলে মনে হয় না৷ সায়েন্স এবং পপুলার কালচারে এটা দাবার মতই সমান আগ্রহোদ্দীপক। দাবায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের পাশাপাশি গো গেমেও উহা বিদ্যমান৷ চার ম্যাচের একটা টুর্নামেন্টে ডিপমাইন্ড কোম্পানির নির্মিত আলফা-গো নামের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সাবেক চ্যাম্পিয়ন লি সে-দল'কে হারিয়ে প্রথম আলোচনায় আসে। এ নিয়ে ইউটিউবে একটা দুর্দান্ত ডকুমেন্টারিও আছে৷ এই অঘটনের পরে লি সে-দল গো খেলা থেকে অবসরে চলে যান। তিনি জানানঃ 'গো খেলায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আসার কারণে বুঝতে পেরেছি আমি আর শীর্ষে নাই। এমনও যদি হয়, অমানুষিক পরিশ্রম করে আমি ১ নাম্বারে থাকি- তবুও এমন একটা জিনিসের অস্তিত্ব আছে যাকে কখনো হারানো যাবে না!'

TIME


দাবায় এই ক্রাইসিসটা মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। যেটা শুরু হয়েছে ডিপব্লু'র উত্থানের মধ্য দিয়ে৷ গ্যারি কাসপারভকে হারানোর পর নানান জল্পনা কল্পনা গেলো, চারদিকে তখন হৈচৈ পড়ে গেলো, এই বুঝি মানুষের ব্রিলিয়ান্সি শেষ হয়ে গেলো দাবায়! এরপর আরো নানান ইন্টেলিজেন্স আসলো। ডিপব্লু'র থেকেও কোটিগুণ শক্তিশালী ইঞ্জিন তৈরি হলো। ইঞ্জিন বনাম ইঞ্জিন চ্যাম্পিয়নশিপ তো এখন নিয়মিতই হয়।

Garry Kasparov playing with deepblue! © SCIENTIFIC AMERICAN


ইঞ্জিনের সাথে মানুষের ফারাক একটা মেজর জায়গায় আছে। জায়গাটা হচ্ছে- পার্ফেক্ট চাল খুঁজে পাওয়া নিয়ে৷ একজন মানুষ সর্বোচ্চ ৮/৯ চাল পর্যন্ত আগাম দেখতে পারে (সেটা প্রায় সবসময়ই চেকমেটিং প্যাটার্নের ক্ষেত্রে), এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি একটা অনির্দিষ্ট সময় ব্যবহার করছে৷ অন্যদিকে, একটা শক্তিশালী ইঞ্জিন সেকেন্ডে হাজার হাজার লাখ লাখ চাল বিশ্লেষণ করে পার্ফেক্ট চালে উপনীত হচ্ছে৷
আবার, একটা নির্দিষ্ট পজিশনের জন্য শক্তিশালী চাল খুঁজে পাওয়া মানুষের জন্য দুষ্কর হলেও ইঞ্জিনের জন্য একটা কেবলই অন্য নিয়মিত চাল দেয়ার মতই সোজা!


গো গেমের কথাই ধরা যাক৷ লি সে-দল'র সাথে আলফা-গো'র দ্বিতীয় ম্যাচটায় আলফা-গো'র ৩৭ নাম্বার চাল সবাইকে অবাক করে দিলো৷ কেননা, আপাতদৃষ্টিতে সেই চালকে সবাই 'ভুল' বলেই ভাবছিলো। কমেন্টেটর যারা ছিলেন, তারা সবাই-ই গো গেমে হায়েস্ট র‍্যাংকের প্লেয়ার, আলফা-গো'র এমন চালে তারাও যারপরনাই বিস্মিত। কিন্তু পরিশেষে, আপাতাদৃশ্যে 'ভুল' চালটাই গেমটাকে দারুণভাবে ঘুরিয়ে দেয় এবং আলফা-গো চ্যাম্পিয়ন লি সে-দল'কে হারিয়ে সেই গেম জিতে নেয়।


ইঞ্জিনের সাথে হয়তো মানুষের মেধা কখনোই পেরে উঠবে না। কিন্তু, তাদের সাথে মিলে গ্রাউন্ডব্রেকিং জিনিসপাতি অবশ্যই করা সম্ভব। আর এখানেই মানবসভ্যতার 'পজিশনাল এডভান্টেজ' নিহিত!

(You can follow me on TWITTER , and my Facebook also!)